প্রত্যয় ডেস্ক, রাঙামাটি প্রতিনিধিঃ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক গৃহিত ছয় মাস ব্যাপী ‘মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প’ বাস্তবায়নে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বাস্তবায়নকারী স্থানীয় এনজিও ‘আশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র/আশিকা ডেভেলপমেন্ট এসোশিয়েট’ এর বিরুদ্ধে।
অভিযোগ গুলোর মধ্যে রয়েছে-কেন্দ্রে কাল্পনিক শিক্ষক নিয়োগ, ভূয়া কেন্দ্র দেখানো, প্রতিটি কেন্দ্রে দু’জন শিক্ষকের পরিবর্তে একজন শিক্ষক দিয়ে কেন্দ্র পরিচালনা করা, শিক্ষকদেরকে নির্ধারিত বেতন প্রদান না করা, পাঁচ দিনের পরিবর্তে দুই দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শিক্ষা উপকরণ ও কেন্দ্র পরিচালন ব্যয়ে ব্যাপক অনিয়ম ইত্যাদি।
এভাবে সরকারের গৃহিত সকল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি চলতে থাকলে দেশ এবং জাতি কতটুকু সুফল পাবে এ নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে যায়।
বিগত ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাামটি জেলার কাউখালী উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।
কাউখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলে এসব ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রকল্প তথ্যমতে মোট ২৬৫ টি শিক্ষাকেন্দ্রে দু’জন করে মোট ৫৩০ জন শিক্ষক নিয়োজিত করার কথা থাকলেও বাস্তবে মাত্র ১৯০ জন শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে।
প্রকল্পে প্রতি শিক্ষকের মাসিক বেতন ধরা ছিল ২৪০০ শত টাকা। সে অনুযায়ী পুরো ছয়মাসে একজন শিক্ষক বেতন পাওয়ার কথা ছিল ১৪ হাজার ৪ শত টাকা। কিন্তু পুরো ৬ মাসে কেউ ১০ হাজার, কেউ বা ৭-৮ হাজার টাকা পেয়েছিল বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষকদের ৫ দিনের প্রশিক্ষণের পরিবর্তে মাত্র দুই দিনের ট্রেনিং দিয়ে ভাতা বাবদ প্রত্যককে ৬০০ শত টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়েছিল।
হিসাব করলে দাড়ায়, ৫৩০ জন শিক্ষকের ৬ মাসের মোট বেতন ৭৬ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা। শিক্ষকদের বেতনের টাকা সরকারি তহবিল থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদানের কথা থাকলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার্থে গুটি কয়েক শিক্ষকদেরকে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ইউএনও কর্তৃক বেতন প্রদান করা হয় বলে জানা যায়।
প্রকল্প নিয়মানুযায়ী মোট ৫৩০জন শিক্ষক নিযোগ করার কথা ছিল। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে বাস্তবে মাত্র ১৯০ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এবং সে সকল শিক্ষকদেরকেও প্রকল্পে নির্ধারিত বেতন প্রদান করা হয়নি বলে শিক্ষকরা জানায়। তদুপরি যে ২৬৫ টি শিক্ষাকেন্দ্র দেখানো হয়েছিল তার অধিকাংশ কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিলনা বলেও জানান স্থানীয়রা।
তথ্যানুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, বেতবুনিয়া ইউনিয়নে ৫৩ নং ’শিলছড়ি পাড়া কেন্দ্রর কোন অস্তিত্বই ছিলনা। সেই কেন্দ্রে ক্ষিতেন চাকমা এবং আনন্টা চাকমাকে শিক্ষক দেখানো হলেও সেসব শিক্ষকের হদিস পায়নি সংবাদ কর্মীদের অনুসন্ধানি টিম।
খোজ নিয়ে জানাগেছে, শিলছড়ি গ্রামটি শতভাগ মারমা সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রাম সত্বেও সেখানে দু’জন চাকমা শিক্ষক কেমন করে চলে আসলো তা নিয়ে রহস্য থেকে যায়। আবার, ‘উত্তর নাল্যছড়ি পাড়া কেন্দ্রটি’ বেতবুনিয়া ইউনিয়নে দেখানো হলেও সেখানে সেনামে কোন গ্রাম নেই বলে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান খইচাবাই তালুকদার জানান। অথচ উক্ত কেন্দ্রে অনুপ কুমার চাকমা এবং শ্রপন চাকমাকে শিক্ষক হিসেবে দেখানো হলেও এদুজন কোন সময় ঐকেন্দ্রে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেননা বলে জানিয়েছেন অনুপ কুমার চাকমা। আশিকা অফিসের লোকজন শুধু দু’দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং তাতে দুদিনের প্রশিক্ষণ ভাতা ৬০০শ টাকা দেওয়া হয়। এরপর তার সাথে অশিকার কেউ যোগাযোগ করেননি বলে জানয়েছেন অনুপ। অধিকন্তু কেন্দ্রের অন্য শিক্ষক শ্রপন চাকমাকেও চিনেন না বলে তিনি জানান।
ফটিকছড়ি ইউনিয়নের ডাবুয়া লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার কেন্দ্রে’র শিক্ষক চিংচা থোয়াই এর সাথে কথা বললে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কেন্দ্রে মাত্র তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। তার কেন্দ্রে মাত্র ১০/১২ জন শিক্ষার্থী ছিল। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫/৩০জন শিক্ষার্থী থাকার কথা।
‘পুরো ছয় মাসে আমি বেতন বাবদ মোট ৭ হাজার টাকা পেয়েছিলাম এবং বাকী টাকা গুলো আমাকে এখনও দেয়া হয়নি,” বলেছেন চিংচা থোয়াই।
ফটিকছড়ি ইউনিয়নে সুপারভাইজার পদে এবং একই ইউনিয়নে ‘নাভাঙ্গা পাড়া-১ সরকারী কেন্দ্রে’ শিক্ষক পদে একই ব্যক্তি নিমকা চাকমার নাম পাওয়া যায়। এ বিষয়ে নিমকা চাকমার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
একই ইউনিয়নে ’টুনকিয়া পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে-১’ রিপন চাকমা ও ববিতা চাকমাকে শিক্ষক দেখানো হলেও তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষক ছিলেননা বলে রিপন চাকমা জানান।
তবে তিনি জানিয়েছেন যে, সেই কেন্দ্রে শিক্ষক হিসেবে নিপন চাকমা নিযুক্ত ছিলেন।
কলমপতি ইউনিয়নের ’আদর্শ গ্রাম পাড়া কেন্দ্রে’ দিলোয়ারা আক্তার ও ফরিদা জেসমিন এ দুজনকে শিক্ষক দেখানো হলেও সেখানে মাত্র একজন শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন বলে স্বীকার করেন দিলোয়ারা। প্রতি মাসে মাত্র ১০৮০ টাকা করে তাঁকে বেতন দেয়া হয়েছিল বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন তিনি।
বেতবুনিয়া ইউনিয়নের ’সোনাইছড়ি পাড়া কেন্দ্র’র শিক্ষক তালিকায় জয় চাকমা ও সুপ্রিয়া চাকমা এ দুজনের নাম থকলেও কেবল জয় চাকমাই সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বলে উভয়ের সাথে কথা বলে জানা যায়।
এবিষয়ে সুপ্রিয়া চাকমার সাথে কথা বললে তিনি জানিয়েছেন, তিনি শুধু ’আশিকা’ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ শিক্ষক পদে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে চুড়ান্ত করা হয়েছিল কিনা তা তিনি জানেন না। তা সত্বেও শিক্ষকের তালিকায় তাঁর নাম কিভাবে এলো সে বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্ত টিম গঠন করে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে এনজিও আশিকার আরো বড় ধরণের অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র মিলবে বলে এলাকার লোকজন মনে করছে।
আশিকার নির্বাহী পরিচালক বিপ্লব চাকমার সাথে কথা বললে তিনি এসব অনিয়মের কথা অস্বিকার করে বলেন, কাউখালীর সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক গৃহিত ছয় মাস ব্যাপী ‘মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প’ মেয়াদ শেষ, বর্তমানে চলমান আছে বাঘাইছড়ি আশিকা ,লংগদু, বিলাইছড়ি স্থানীয় এনজিও সাইনিং হিল ও রাজস্থতলীতে আশ্রয়ঙ্গন এনজিও প্রকল্প চলমান । ঢাকা থেকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো থেকে সরাসরি সবকিছু মনিটর করা হয়েছিল। অর্থ সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ জেলা প্রশাসনের ইউএনও ও এডিসি (অর্থ) করেছিলেন। তাছাড়া শিক্ষকরা তাদের কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাশের হার অর্জন করতে না পারায় তাঁদের বেতন ও অন্যান্য খরচ ফেরত দেয়া হয়েছিল জানান বিপ্লব।
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শতরুপা তালুকদার এর সাথে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, তিনি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ মুহূর্তে কাউখালীতে যোগদান করেছেন। তবে তিনি অনিয়মের কারনে প্রকল্পের কার্যকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং প্রায় ৮লাখ টাকা ফেরত দেয়া হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন। ##
রিপোর্টঃ চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙামাটি ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ইং